মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২১

আলা হযরত কি ইংরেজদের দালাল ছিলো? ধারাবাহিক আলোচনা,পর্ব - ২


আলা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি'র ইংরেজবিরােধিতার কিছু নমুনা:

 যখন কেউ একটি জাতিকে ভালবাসে তখন তিনি সেই জাতির সবকিছুকে ভালবাসে। অথাৎ সেই জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজ্য, আইন, শিক্ষাব্যবস্থা, সভ্যতা, ধ্যান-ধারণা, দর্শন, আশ্রয়াধীন মানুষ, অনুসারীবৃন্দ, সাহায্যকারী ও সে জাতির চরিত্র বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সব কিছুই তিনি ভালবাসেন। এটাই হলাে প্রকৃত ভালবাসার আলামত। হাদিস শরিফে আছে - (আরবীর বাংলা অনুবাদ, কিতাবে আরবী উল্লেখ আছে।) "প্রেমিক সর্বদা তার প্রেমাস্পদের আলােচনা করে"।

আরাে বিবৃত হয়েছে। (আরবীর বাংলা অনুবাদ,কিতাবে আরবী উল্লেখ আছে।)কোন বস্তুর ভালোবাসা তার প্রেমিককে অন্ধ ও বধির করে দেয়।"

বর্ণিত সূত্রমতে দেখা যায় যে, আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ব্রিটিশ ও ইংরেজদের ঘাের বিরােধী। আসুন, পর্দা আবৃতকারীদের পর্দা সরিয়ে দেই এ মহান ইমামের পবিত্র সত্তা থেকে। বিবেককে নিয়ে যাই সত্যের দিকে। অপবাদকারীদের দূর্গে হানি আঘাত।


খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের দ্বারা যবেহকৃত পশু ভক্ষণ ও তাদের নারীদের বিয়ে করার ব্যাপারে অভিমতঃ-

 খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের দ্বারা যবেহকৃত পশু খাওয়া ও এদের নারীদের বিয়ে করা বৈধতার ঘােষণা দেবেন একজন ইংরেজপ্রীত আলেম। একজন ইংরেজ নিমকপুষ্ট আলেমের কাছে এটাই আশা করা যায়। এ ব্যাপারে শরিয়তের

বিধানকে বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে বৈধতার পক্ষে দেখিয়ে মুসলমানদেরকে বিপদগামী করে ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জন করাই হবে তার কাজ। কিন্তু আ'লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের যবেহকৃত পশু ও তাদের নারীদের বিবাহ করার ব্যাপারে মুসলমানদেরকে কঠোর হুঁশিয়ার করে এগুলােকে অবৈধ ঘােষণা করেছেন। সাথে সাথে যে সমস্ত ফোকাহা এ ব্যাপারে বৈধতার পক্ষাবলম্বন করেছেন তাদের বিশদ ব্যাখ্যা ও খণ্ডন করেছেন। দেখুন, নিম্নে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

১৩১৮ হিজরিতে ভারতের মাদ্রাসায়ে ইসলামিয়্যার শিক্ষক হাফেজ আবদুল আজিজ সাহেব আ'লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি'র কাছে প্রশ্ন করেছিলাে যে, অধিকাংশ দ্বীনি কিতাবসমূহে আহলে কিতাবের যবেহকৃত পশু হালাল বলে ঘােষিত হয়েছে। তাহলে বর্তমান ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের যবেহকৃত পশু হালাল না হারাম?

এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে কোনাে ধরনের সন্দেহ নেই যে, খ্রিষ্টান যারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর সন্তান বলে আক্বিদা পােষণ করে এবং ইহুদি যারা হযরত ওযাইর আলাইহিস সালামকে খােদার পুত্র বলে মনে করে এ সমস্ত খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের যবেহকৃত পশু খাওয়ার বৈধতা নিয়ে আমাদের ইমামগণের মতানৈক্য রয়েছে। অধিকাংশরা নিষিদ্ধ বলে অভিমত পেশ করেছেন এবং এটার উপরই চূড়ান্ত রায় বলে বিবৃত হয়েছে। আর কিছু কিছু ফকিহ মুহাদ্দিসগণ বৈধ বলে ঘােষণা দিয়েছেন। যেমন- 'মাসতাসদা নামক কিতাবে নিষিদ্ধতা ও 'দুররে মুখতার এ বৈধতার ঘােষণা পাওয়া যায়। তবে মাকরূহ হওয়ার ক্ষেত্রে কারাে এখতেলাফ নেই, জরুরী ব্যতিরেকে। সত্যিকার কিতাবিদের যবেহ কৃত প্রাণী খাওয়াকেও ওলামাগণ অপছন্দ করেছেন। তাহলে উপর্যুক্তটি আরাে বেশি অপছন্দনীয় হবে। আর যারা বৈধতার ঘােষণা দিয়েছে এ শর্তে যদি যবেহ করার সময় আল্লাহ তায়ালার নাম নেয়া হয় এবং সাথে যদি ঈসা আলাইহিস সালাম'র নাম উল্লেখ না হয়। আর যদি ইচ্ছাকৃত তকবির ছেড়ে দেয় তাহলে মুসলমানদের যবেহকৃত পশুও বৈধতা হারাবে। ইহুদি নাসারা তাে দূরের কথা।

উপর্যুক্ত আলােচনাটি ছিলাে ইসলামি আইন বিষয়ক এবং ইমামদের মতানৈক্যের ব্যাপার। কিন্তু আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ বিষয়ে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করে বলেন-

(উর্দুর বাংলা অনুবাদ,কিতাবে উর্দু উল্লেখ আছে) "বর্তমান খ্রিষ্টানদের অবস্থা সম্পর্কে আমি জানি। তারা যবেহ করার সময় না তকবির বলে, না যবেহ করার মত যবেহ করে। মুরগী ও পাখিদেরকে তাে গলা টিপে হত্যা করে। এ অধম এটা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। বর্তমান খ্রিষ্টানদের যবেহকৃত পশু নিশ্চয় হারাম (নিষিদ্ধ)। আর ইহুদির বেলায়ও একই হুকুম"। (আলা হযরত ইমাম আহমদ রেখা রচিত 'ফাতাওয়ায়ে রেযভীয়্যাহ, খন্ড - ০৮, পৃষ্ঠা ৩৩১, সুন্নি দারুল এশায়ত মুবারক, পুরাতন আজমগড়, প্রকাশকাল - ১৯৯২ ইংরেজী।)

খ্রিষ্টান, ইহুদি ও নাসারাদেরকে বিয়ে করার বৈধতা-অবৈধতার উপর দীর্ঘ কুরআন- সুন্নাহ ও ইসলামি আইনবিদদের ফয়সালা বিবরণীর পর আ'লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি ব্যক্তিগত অভিমত পেশ করে বলেন-

(উর্দুর বাংলা অনুবাদ,কিতাবে উর্দু উল্লেখ আছে) "খ্রিষ্টান ও ইহুদি নারীদের বিয়ে করা ও তাদের যবেহকৃত পশু হালাল-হারাম বিষয়ে যখন ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, যদিও বৈধতার পক্ষে রায় সাবস্ত্য হয়েছে, তারপরেও খ্রিষ্টানদের জবেহকৃত ও তাদের নারীদেরকে বিবাহ করা থেকে সাবধানতা অবলম্বন ও বিরত থাকাই জরুরি। আজকাল কিছু ইহুদি এমনও পাওয়া যায়, যারা হযরত ওযাইর আলাইহিস সালামকে খােদার পুত্র মনে করে। তাদের দ্বারা যবেহকৃত জন্তু খাওয়া ও তাদের নারীদের বিয়ে করা থেকে বেঁচে থাকা জরুরী জ্ঞান করুন। এ সমস্ত বিষয়ে ইমামদের মতানৈক্যে পতিত হওয়াটা সতর্ক মানুষের কাজ নয়। যদিও বাস্তবে এ সমস্ত ইহুদি ও নাসারা আল্লাহ তায়ালার কাছে কিতাবিও হয় তবুও তাদের নারীদের বিয়ে করা এবং তাদের দ্বারা যবেহকৃত পশু ভক্ষণ করাতে আমাদের কোনাে লাভ নেই। না শরিয়ত আমাদের উপর তা বাধ্যতামূলক করেছে, না (আলহামদুলিল্লাহ) আমাদের এটার প্রয়ােজন আছে। বস্তুত কিতাবি হওয়া শর্তেও ওলামাগণ অপ্রয়ােজনে বিরত থাকাই শ্রেয় বলে অভিমত পেশ করেছেন।

'ফতহুল কাদিরে' রয়েছে, "কিতাবিদের সাথে নিকাহ জায়েয, তবে বিরত থাকাটাই শ্রেয়। তাদের যবেহকৃত পশুও বিনা প্রয়ােজনে না খাওয়াই উত্তম।" যদি বৈধতাদানকারী ওলামাদের মাযহাব সত্য হয়, আর বাস্তবে যদি এরা আল্লাহর নিকট তাদের এতেকাদের কারণে মুশরিক বলে গণ্য হয়, তবে তাদেরকে বিয়ে করা নির্ঘাত ব্যভিচার ও তাদের যবেহকৃত জন্তু খাওয়া শর্তহীন হারাম বলে বিবেচিত হবে। নাউযুবিল্লাহ, তাহলে তাে বুদ্ধিমানের কাজ এমন হতে পারে না, যার এক দিকে অনভিপ্রেত এবং অপর দিকে একেবারেই নিষিদ্ধ। এ অধম এমনটি ধারণা করতাম শেষ পর্যন্ত আল্লাহর তৌফিকে 'মাজমাউল আনহার নামক কিতাবে এ ধারণার স্বপক্ষে রায় দেখলাম। যেখানে তিনি বলেন- বর্তমান আমাদের দেশের প্রশাসকদের উচিত তারা যেনাে খ্রিষ্টানদের যবেহকৃত পশু ভক্ষণে নিষেধ করেন।

কেননা বর্তমানে খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলে ব্যাখ্যা করে। যখন প্রয়ােজনীয়তাও বিদ্যমান নেই তাহলে সাবধানতা অবলম্বনই ওয়াজিব। কেননা তাদের যবেহকৃত পশু নিয়েও ওলামাদের এখতেলাফ বিদ্যমান। যা আমি পুর্বে আলােচনা করেছি। যখন প্রয়ােজনই নেই, তখন নিষিদ্ধতার দিকটাকে প্রাধান্য দেয়া উত্তম।

প্রিয় পাঠক! ইমামে আহলে সুন্নাত আ'লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি'র দূরদৃষ্টির নমুনা দেখুন কতই চমৎকার! তিনি ইহুদি, খ্রিষ্টান তথা বিজাতীয়।মহিলাদের সাথে মুসলমান ছেলেদের বিবাহ-শাদীর বন্ধনকে তীব্রভাবে নিষিদ্ধ ঘােষণা করলেন। যদিও ইসলামি আইনবিদদের মধ্যে কিছু শিথিলতা লক্ষ্যণীয়।

তিনি তাদের এখতেলাফ ও শিথিলতায় মনােনিবেশ না করার জন্য কীভাবে সতর্ক করলেন! কারণ তিনি জানতেন, মুসলমানদের পতনের কারণসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলাে মুসলমানদের পবিত্র রক্ত বিজাতীয় রক্তের সাথে মিশে যাওয়া।

তুরস্কের ওসমানি রাজত্বে বিপদের কারণ হলাে, অমুসলিম দাস-দাসীদের বিবাহ করা। রাজাদের ব্যস্ততা থাকতাে রাজ্যের যাবতীয় কর্মে, আর রাজমহলে যাবতীয় কর্তৃত্ব থাকতাে অমুসলিম রাণীদের কাছে, যাদেরকে তারা বিবাহ করেছিলাে।তাইতাে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ওস্তাদ কুরদ আলি সাহেব ওসমানি রাজত্ব অধঃপতনের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন- (আরবীর বাংলা অনুবাদ,কিতাবে আরবী উল্লেখ আছে।) "ওসমানি রাজত্ব পতনের মূল কারণ হলাে বহু খ্রিষ্টান দাস-দাসীদের সাথে মিলনের কারণে বাদশাহদের রক্ত বিগড়ে গিয়েছিলাে"।(ইমাম আহমদ রো রচিত"এ'লামুল আলাম বি-আন্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম" (ফাতাওয়ায়ে রেফভীয়্যাহ), খণ্ডঃ ১৪,পৃষ্ঠা ১২২, মারকাযে আহলে সুন্নাত মরকাত পূর্ব বন্দর, গুজরাট। প্রকাশকাল- ২০০২ ইংরেজি। আল ইসলাম ওয়াল হাজারাতুল আবরিয়া, খন্ড - ০২, পৃষ্ঠাঃ ৪৯৯। মাওলানা সাঈদ আহমদ আকবরবাদী মুসলিমদের উত্থান পতন", (অনুবাদে মৌলভি মুহাম্মদ খুরশিদ), বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৯ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা: ১৫১ ও আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি'র উপর আরোপিত অপবাদের জবাব,পৃষ্ঠা - ৭৬,৭৭,৭৮,৭৯,৮০ )।

ইসলামী আলোচনা ব্লগ সাইট ভিজিট করুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন