_______________
যুগে যুগে কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলামের প্রচার-প্রসারে এমন সব বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব ধরাধামে শুভাগমন করেন যাদের সৃজনশীল কর্মতৎপরতায় ইসলাম আজো বিশ্বমাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁদের অন্যতম। তিনি ১২৭২হিজরীর ১০ শাওয়াল (১৪ জুন ১৮৫৬) ভারতের (ইউপি) বেরেলী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর বুযুর্গ দাদা নাম রাখলেন মুহাম্মদ আহমদ রেযা খান। পিতা আল্লামা নক্বী আলী খান ডাকতেন ‘আহমদ মিঞা’ মাতা স্নেহের সাথে ‘আমান মিঞা’ নামে ডাকতেন। সংখ্যাতাত্ত্বিক নাম ‘আল মুখতার’ ১২৭৬ হিজরীতে চার বছর বয়সে কুরআন মজীদ পাঠ সমাপ্ত করেন তিনি। খোদা প্রদত্ত অসাধারণ মেধাশক্তির কারণে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় ১২৮৬ হিজরীতে (১৮৬৯) সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপনী সনদ অর্জন করেন। মাওলানা বেরলভী নিম্নোক্ত শিক্ষকদের নিকট থেকে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহর সনদ অর্জন করেন।
১. শাহ্ আলে রসূল মারহারভী (ওফাত ১২৯৬ হি./১৮৭৮ খ্রি.
২. মাওলানা নক্কী আলী খান (ওফাত ১২৯৭হি./১৮৭৯খ্রি.
৩. শায়খ আহমদ বিন যায়নী দাহলাম মক্কী (ওফাত ১২৯৯হি./১৮৮১খ্রি.)
৪. শায়খ আবদুর রহমান সিরাজ মক্কী (ওফাত ১৩০১হি./১৮৮৩খ্রি.)
৫. শায়খ হুসাইন বিন সালেহ (ওফাত ১৩০২হি./১৮৮৪খ্রি.)
৬. মাওলানা আবদুল আলী রামপুরী (ওফাত ১৩০৩হি./১৮৮৫খ্রি.)
৭. শায়খ আবুল হুসাইন আহমদ আন্নূরী (ওফাত ১৩২৪হি./১৯০৬)
৮. মির্জা গোলাম কাদের বেগ। (ওফাত ১৩০১হি./১৮৮৩খ্রি.)
মাওলানা বেরলভীর হাদীসের সনদ সূত্র হযরত শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী, হযরত শায়খ আবেদ সিন্ধী ও আল্লামা আব্দুল আলী লক্ষেèৗভীর সাথে সম্পৃক্ত। তাঁর কর্মময় জীবনের পরিধি ও অবদান ব্যাপক। ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর জীবন-কর্ম উপস্থাপন করা রীতিমত দুরূহ্ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। হুব্বে রাসূল তথা নবীপ্রেম তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্জন। প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, সফল বিচরণ। ধর্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ব, সূফীতত্ত্বসহ প্রতিটি বিষয়ে তাঁর অবদান ছিলো বিস্ময়কর। এককথায় তিনি ছিলেন এক বিরল প্রতিভা সম্পন্ন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। কুরআন-সুন্নাহ্, ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে তাঁর জ্ঞান গবেষণার বিশাল জগত বিনির্মিত। পঞ্চাশোর্ধ বিষয়ের উপর তাঁর ছোট বড় সবমিলে দেড় সহস্রাধিক গ্রন্থাবলী ইসলামের এক অমূল্য সম্পদ। ইসলামী আক্বিদা, বিশ্বাস ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি, ধর্মনীতি, বাণিজ্যনীতি, আমদানী নীতি, রপ্তানীনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর প্রদত্ত নির্দেশনা ও অনুসৃত নীতিমালা সংকট মুক্তির পাথেয়। কুরআন সুন্নাহ্ ভিত্তিক শরয়ী বিধানের যথার্থ উপস্থাপনায় তাঁর গবেষণাধর্মী নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী যুগ যুগ ধরে দিশারীর ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। ৬৮ বছর ব্যাপী তাঁর কর্মময় জীবনে তিনি মাযহাব মিল্লাতের যে অপরিসীম খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা ইতিহাসের এক বিরল অধ্যায়।
ধর্মীয় জটিল কঠিন বিষয়াদির বিশ্লেষণধর্মী সমাধান দানের পাশাপাশি জ্ঞান বিজ্ঞান, দর্শন জ্যৌতিষশাস্ত্র। নক্ষত্র বিদ্যায় তিনি প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।
১৯১৯ সালের ১৮ অক্টোবর এক্সপ্রেস পত্রিকায় আমেরিকার জ্যোতিষবিজ্ঞানী প্রফেসর আলবার্ট এফপুরট ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, ১৯১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর কয়েকটি গ্রহ সূর্যের সামনে চলে আসার দরুন, উদ্ভূত মধ্যাকর্ষণ পৃথিবীতে মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি করবে। আ’লা হযরতকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কুরআন-সুন্নাহর গবেষণার আলোকে মহাকাশ বিজ্ঞানীর এ ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা প্রমাণ করেন। ১৭ ডিসেম্বর দেখা গেল পৃথিবীর কোথাও কোন প্রকার বিপর্যয় ঘটেনি। আ’লা হযরতের গবেষণা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হলো। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে এটা ছিল ইসলামের এক মহা বিজয়। মার্কিন বিজ্ঞানীদের মতবাদ খণ্ডনে আলা হযরত পরপর তিনটি গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেন।
১. আল কালিমাতুল মূলহামাতু ফিল হিকামাতিল মুহকামা লিওয়াহিল ফালসাফাতিল মুশাম্মাহ্ (১৯১৯খ্রি.)
২. ফওজে মুবীন দর রদ্দে হরকতে যমীন। (১৯১৯ খ্রি.)
৩. নুযুলে আয়াতে ফুরকান বি সুকুনে যমীন ওয়া আসমান। (১৯১৯খ্রি.)
উপমহাদেশে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ও ধর্মীয় অঙ্গনে আক্বিদাগত বিভ্রান্তির নাজুক সন্ধিক্ষণে মুসলিম মিল্লাতের ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। ১৮৯৭ সালে ভারতের পাটনায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কনফারেন্সে মাওলানা বেরলভীর প্রদত্ত ভাষণ মুসলমানদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচনা করেছে।
তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের পথিকৃৎ। ১৯৪৭ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাঁরই চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ন। তিনি ১৩৩৯হিজরিতে (১৯২০খ্রি.) তরকে মুয়ালাত তথা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঐতিহাসিক ফতোয়ার আলোকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার প্রয়াসে সকলকে সজাগ করেন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্বি-জাতি তত্বের বিকল্প নেই বলে ঘোষণা দেন। এ ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালে আল হুজ্জাতুল মুতামিনা বি আয়াতিল মুমতাহিনা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। যা উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক দলীল। এ ছাড়াও তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন।
১. এলামূল এলাম বি আন্না হিন্দুস্তান দারুল ইসলাম (১৮৮৮খ্রি.)
২. দাওয়ামূল আয়শি ফী আইম্মাতি কুরাইশ (১৯৯০খ্রি.)
৩. তাদবীর ফালাহ্ ওয়া নাজাত ওয়া ইসলাহ্ (১৯১২খ্রি.)
ইসলামী আলোচনা ব্লগ সাইট ভিজিট করুন
পরবর্তীতে ভারতবর্ষে মাওলানা বেরলভীর রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবাদর্শে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এলেন। তাদের নেতৃত্বে চলতে লাগলো মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৩০ সালে ড. আল্লামা ইকবাল ভারতের এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হলে তিনি মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার করেন। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম লীগের আন্দোলন সফল হলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হল এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলো।
এ মহামনিষীর অনন্য প্রতিভা মহান স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি। বৈচিত্রে মৌলিকতায় ও সৃষ্টির বিপুলতায় তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বিশ্বের অসংখ্য জ্ঞাণীগুণী পণ্ডিত বিশেষজ্ঞগণ এ মনীষীর অনন্য প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লামা ড. ইকবাল তাঁকে ‘যুগের আবু হানিফা’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. স্যার জিয়াউদ্দিন তাঁকে নোবেল প্রাইজের যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৩৩০হিজরীর (১৯১১খ্রি.) তিনি শায়খ মুসা আলী আশশামী আল আযহারী কর্তৃক ‘ইমামূল আইম্মা আল মুজাদ্দিদুল উম্মাহ্’ তথা চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত হন।
হেরমে নববী শরীফের ওস্তাদ ফখরুল ওলামা মাওলানা আলী ইবনে আহমদ তাঁর সম্পর্কে বলেন ‘‘কেন এরূপ হবেন না? তিনি তো (ইমাম আহমদ রেযা) এ যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিম মিল্লাতের ত্রাণকর্তা। আ’লা হযরতের নিকট ফত্ওয়া প্রার্থী মীর্যা মুহাম্মদ ইসমাঈল বেগ ২৪ শাবান ১৩৩৯ হিজরীতে স্বীয় আবেদনপত্রে আ’লা হযরতকে যুগের জুনাইদ ও যুগের শিবলী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মাওলানা কাজী গোলাম গিলানী (শামস আবাদ পাঞ্জাব) ১৮ রজব ১৩৩১হিজরীতে আ’লা হযরত সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘ফাযেলে বেরলভী বর্তমান শতাব্দির মুজাদ্দিদ। জগতের ত্রাণকর্তা, জ্ঞান ভাণ্ডার, আদর্শ চরিত্রের আধার, পরম সম্মানিত আলেমকূলের সর্দার, বিজ্ঞজনদের অগ্রবর্তী।
গুজরাটের বিশিষ্ট আলিম আল্লামা আনসারুল হক দেহলভী ১৩১৭হিজরীর ৭ রজব এক ফতওয়ার শিরোনামে আ’লা হযরতকে সম্মানজনক মর্যাদামণ্ডিত সম্বোধনে ভূষিত করেন।
‘আলিমগণের সম্মানিত, কামিলগণের পুরোধা, আল্লাহর নিদর্শনাদির অন্যতম নিদর্শন, আল্লাহর বরকতসমূহ হতে মহান বরকত। দ্বীনের সংস্কারক, আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের যোগ্য প্রতিনিধি। তিনি আরো বলেন, মাওলানা রেযা বেরলভী আমাদের পরম শ্রদ্ধাস্পদ ঈমানদার মানব দানবদের উপর মহীয়ান অনুগ্রহ পরায়ণ স্রষ্টা আল্লাহ্ সর্বদা তাঁর ফুয়ুজাত প্রবহমান রাখুন।
বিশ্ব বুকে যাঁরা আপন কর্মে মানুষের অন্তর্জগতে ঠাঁই করে নিয়েছেন, তেমনি এক কিংবদন্তি মহামনীষীর নাম ইমাম আহমদ রেযা। বিশ্বব্যাপী আ’লা হযরত নামে যিনি পরিচিত, আজ হতে ৯৪ বছর পূর্বে ১৩৪০ হিজরীর ২৫ সফর শুক্রবার বাদ জুমা ২টা ৩৮ মিনিটে ইসলামী দুনিয়ার এ মহান মুজাদ্দিদ জ্ঞান জগতের বিস্ময় তাঁর মওলায়ে হাকিকী রফীকে আ’লার সান্নিধ্যে গমন করেন। ভারতের বেরেলী শহরে সুন্নীয়তের নিশান বরদার দারুল উলুম মানযারুল ইসলাম এর উত্তর পার্শ্বস্থ মাযার শরীফে সুন্নী জগতের এ মহান দিকপাল চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তাঁর অনুসৃত আদর্শ অনুসরণে আল্লাহ্পাক আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন- আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন