আ'লা হযরতের উপর অপবাদের জবাব। পর্ব:- ৬৬
#মুহাম্মদ_আলমগীর।
প্রসঙ্গ: হিন্দুস্থান কি ‘দারুল ইসলাম’, না ‘দারুল হারব’?
‘দারুল ইসলাম' ও 'দারুল হারব' উভয়টি আরবী শব্দ । পরবর্তীতে উর্দু এবং ফার্সী ভাষায়ও শব্দ দু'টি ব্যবহৃত হতে থাকে। এ দু'টি শব্দের যে কোন একটি রাজনৈতিকভাবে যেমন কোন রাষ্ট্রের বিশেষণ, তেমনি ইসলামের বহু অনুশাসন ও বিধি-বিধান এ দু'টি বিশেষণ অনুসারে কার্যকর হয়। তাই এ দু'টি বিশেষণের কোন্টি, কোন রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য, তা নির্ণয়ের জন্য এ দু'টির সংজ্ঞা সম্পর্কে পরিচিত হওয়া আবশ্যক বৈ-কি।
এ দু'টি বিশেষণ সম্পর্কে পরবর্তীতে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা হবে। প্রথমে সংক্ষেপে বলা যায়- ১. 'দারুল ইসলাম' হচ্ছে ওই রাষ্ট্র, যাতে ইসলামী সালতানাৎ বলবৎ থাকে। সূত্র. ফী-রূযুল লুগাত ]
আর 'দারুল হারব' হচ্ছে ওই রাষ্ট্র, যেখানে অমুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ফরয ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পালনে বাধা দেওয়া হয়, বা নিষিদ্ধ। [সূত্র, প্রাগুক্ত)
একথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তারপর দীর্ঘদিন যাবৎ ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এ উপমহাদেশে । তারপর (১৯৪৭ইং) হিন্দুস্থান (ভারত) ও পাকিস্তান দু'টি রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর (১৯৭১ইং) পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু'টি মুসলিম রাষ্ট্র (দারুল ইসলাম) তাতে কারো দ্বিমত নেই; কিন্তু যেহেতু ভারতে তার স্বাধীনতা লাভের পূর্বে দু'শতাব্দিকাল ইংরেজদের শাসন এবং স্বাধীনতা লাভের পরে হিন্দুদের শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেহেতু 'হিন্দুস্থান'কে কি 'দারুল ইসলাম’ বলা যাবে, না 'দারুল হারব' বলতে হবে? এটা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে দেখা যায়, এক শ্রেণীর আলিম তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে শরীয়তের আলোকে অকাট্যভাবে যুগাস্তকারী মীমাংসা (ফাতাওয়া) দিয়েছেন- যথাসময়ে। এ শেষোক্ত বিজ্ঞ ওলামা-ই কেরামের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ও আদর্শ ইমামের ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের ইমাম-ই আহলে সুন্নাত আ'লা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা বেরলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। তিনি ভারতকে 'দারুল ইসলাম' হিসেবে সাব্যস্ত করে ফাতাওয়া প্রণয়ন করে তা প্রকাশ করলেন। কিন্তু ফাতাওয়াটি প্রকাশিত হয়েছে ওনার ইন্তিকালের ৬বছর পর! লেখা হয়েছিলো ইন্তিকালের ৩৪বছর পূর্বে। প্রকাশের পর তখন তা নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা হৈ-চৈ করলেও এ প্রসঙ্গে আ'লা হযরতের ফাতাওয়া বিশুদ্ধই প্রমাণিত হয়েছে ।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ আন্দোলনের পরম্পরায় 'খেলাফত আন্দোলন' ও 'অসহযোগ আন্দোলন' (যথাক্রমে ‘তাহরীক-ই খিলাফত’ ও ‘তাহরীক-ই তরকে মু'আমালাত') (১৯১৯-১৯২০) অতি উল্লেখ্যযোগ্য । এ দু' আন্দোলনের সময়ে আ'লা হযরতের সুচিন্তিত, বাস্তবধর্মী ও দুরদর্শিতালব্ধ অবস্থান ও নির্ভুল মতামত বা ফাতাওয়াকে কেন্দ্র করে বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধিতার ঝড় তুলেছিলো। বস্তুত এটা রাজনৈতিক আবেগ প্রবণতার যুগ ছিলো। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে আ'লা হযরতের খলীফাগণ, সদরুল আফাযিল সৈয়্যদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী ও তাজুল ওলামা মাওলানা মুফতী ওমর নঈমী আলায়হিমুর রহমাহ্ প্রমুখ তাঁদের রাজনৈতিক মেধা, উন্নত চিন্তা ও বোধশক্তি এবং দুরদর্শিতার প্রমাণ রেখে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ওই ভূমিকাকে যতটুকু মূল্যায়ন করা হয়েছিলো, তার চেয়ে বেশী মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছেন পরবর্তী তথা বর্তমানকার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ । তাঁরা নির্দ্বিধায় ঔসব ওলামা-ই দ্বীনের দুরদর্শিতা ও পরিণাম দর্শিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ।
একই পরম্পরায় ওই যুগে আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী আলায়হির রাহমার একটি ফাতাওয়া ‘ই’লামুল আ’লাম বিআন্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম’ (বিজ্ঞজনদের জ্ঞাতার্থে নিঃসন্দেহে হিন্দুস্থান 'দারুল ইসলাম) নামে (১৩০৬হি./১৮৮৮ইং, মুদ্রণে 'হাসানী প্রেস, রেবিলী। প্রকাশিত হয়; যখন হিন্দুস্থানের একশ্রেণীর আধিঃ হিন্দুস্তানকে 'দারুল হারব' সাব্যস্ত করে সুদকে জায়েয।
সাব্যস্ত করেছিলেন । তাদের খণ্ডনে তিনি তাঁর উক্ত ফাওয়ায় লিখেছিলেন
আ'লা হযরত লিখছেন-
" ওইসব লোক সম্পর্কে চিন্তা করতেও আশ্চর্যবোধ হয়, যারা সুদকে বৈধ করার জন্য, যা কোরআনের অকাট্য আয়াতসমূহ (প্রমাণাদি) দ্বারা হারাম বলে সাব্যস্ত এবং এর বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির হুমকি এসেছে, এ দেশকে 'দারুল হারব' সাব্যস্ত করেছেন, আর শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও (এদেশ) থেকে হিজরত করার খেয়ালটুকু পর্যন্ত অন্তরে আনেননি! এ দেশ যেন ওই দিনের জন্য 'দারুল হারব' হয়েছিলো যে, তাতে সুদের মজা লুফে নেবেন এবং পূর্ণ আরামে প্রিয় মাতৃভূমিতে পরিতুষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াবেন! আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন, “তোমরা কি কিতাব' (ক্বোরআন মজীদ)-এর একাংশের উপর ঈমান রাখছো, আরেকাংশের সাথে কুফর করছো?”[সূত্র ই'লামুল আ'লাম, পৃ.৭, ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী]
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী আ'লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিছক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে (সুবিধাবাদীর মতো) ফাতাওয়া আরোপের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ যখন সমাজ তাদের সুবিধানুসারে সুদ নিতে চাচ্ছিলো, তখন হিন্দুস্থানকে ‘দারুল হারব’ সাব্যস্ত করে নিলো, আর যখন রাজনৈতিক সুবিধা ভোগের নিমিত্তে মুসলমানদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে চাইলো তখন আবারো এ দেশকে ‘দারুল হারব' বলে সাব্যস্ত করে নিলো! এ কেমন আবূ লাহাবসূলভ পদক্ষেপ?
[সূত্র, 'হায়াতে মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরলভী, হাশিয়া, পৃ.১০৫, প্রফেসর ড. মাস'উদ আহমদ ]
হিন্দুস্তানকে 'দারুল ইসলাম' সাব্যস্ত করার ফলে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ মহান মুফ্তী চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণের দৃষ্টিশক্তি ধারণ করেন, হিন্দুস্থানে ইংরেজদের দখলদারিত্বকে জবরদস্তিমূলক মনে করেন, মুসলমানদেরকে তিনি এ অধিকার দিচ্ছেন যে, তাঁরা সাধ্যানুসারে দেশের স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হচ্ছে- এ অবস্থানের বিরুদ্ধবাদীদের একথা বুঝে আসছে না যে, হিন্দুস্থানকে 'দারুল হারব' সাব্যস্ত করলে নিজেদের অধিকার থেকে নিজেরাই সরে দাঁড়াতে হয়। কারণ, তাদের ফাতাওয়া মতে, এমতাবস্থায় হিজরত করা ফরয হয়ে যায়, নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার অবকাশটুকু থাকছে না। আশ্চর্য! দীর্ঘ এক হাজার বছর যাবৎ এদেশে রাজত্ব করে মুসলমানগণ এত তাড়াতাড়ি নিজেদের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার পক্ষে না বিবেক সায় দেয়, না এটা ন্যায়বিচারসম্মত হয়। তদুপরি এ প্রশ্নও মনে আসে যে, ইংরেজদের শাসনামলে যদি হিন্দুস্থান 'দারুল হারব' হতে পারে, তবে বর্তমানে হিন্দুদের রাজত্বের ফলে সেটা মুসলমানদের জন্য 'দারুল হারব' হবে না কেন? অথচ ইসলামী রীতিনীতি ও অনুশাসনাদি পালনের ক্ষেত্রে ইংরেজদের শাসনামলে যতটুকু আযাদী ছিলো, এখন ততটুকু আযাদী আছে কিনা তাও অবস্থাদৃষ্টে সুস্পষ্ট হয়ে যায় । অর্থাৎ ততটুকু স্বাধীনতা আছে বলে মনে হবে না। এ থেকে বুঝা গেলো যে, যারা হিন্দুস্তানকে তখন 'দারুল হারব' বলে সাব্যস্ত করেছিলো, তারা নিছক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সুবিধা ভোগের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এটা অন্যদিকে অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের ক্ষতিই করেছিলো ।
আ’লা হযরতের এ ফাতাওয়া আরোপের প্রেক্ষাপট কি ছিলো?
১২৯৮হি/১৮৮০খ্রিস্টাব্দে বদায়ূনে মির্যা আলী বেগ আ'লা তিনটি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলেন । আ'লা হযরত তার জবাবে ‘ই’লামুল আ'লাম বিআন্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম' শিরোনামে একটি ফাট্ওয়া পুস্তক প্রণয়ন করলেন । প্রশ্নগুলো নিম্নরূপঃ
হযরত আহমদ রেযা বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে
প্রথম প্রশ্ন: হিন্দুস্তান কি 'দারুল ইসলাম’ না ‘দারুল হারব’? দ্বিতীয় প্রশ্ন: বর্তমান যুগের ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কি কিতাবী, না মুশরিক?
তৃতীয় প্রশ্ন: বিদ'আতীদের প্রসঙ্গে বিধান কি?
সুতরাং আ'লা হযরত প্রথম প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন ‘‘আমাদের ইমামে আ'যম আবূ হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, বরং 'ওলামা-ই সালাসাহ্' রাহিমাহুমুল্লাহু আজমা'ঈন-এর মাযহাবানুসারে হিন্দুস্থান হচ্ছে 'দারুল ইসলাম; ‘দারুল হারব' মোটেই নয়। কারণ, কোন 'দারুল
ইসলাম' 'দারুল হারব' হবার জন্য, আমাদের ইমাম-ই আযম, ইমামগণের ইমাম হযরত আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মতে, তিনটি বিষয় থাকা আবশ্যক এক. সেখানে শিকী বিধান প্রকাশ্যভাবে জারী করা হবে ।
দুই. ইসলামী শরীয়তের বিধানাবলী মোটেই জারী হতে পারবে না। সাহিবাঈনের মতে এতটুকু যথেষ্ট । কিন্তু এখানে, আল্লাহরই প্রশংসাক্রমে, এমনটি মোটেই মওজুদ নেই।
তিন. বিধানাবলীর বিবেচনায় জনসাধারণকেও দু'ভাগে ভাগ করা হয়- 'দারুল ইসলাম' ও 'দারুল হারব’ । হিন্দুস্থানে যখন ইসলামী শাসন ক্ষমতা ছিলো, তখন হিন্দুস্থান তো 'দারুল ইসলাম’ ছিলোই; কিন্তু যখন হিন্দুস্থানের উপর ইংরেজদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন আলিমদের মধ্যে এ আলোচনা ছড়িয়ে পড়লো এখন হিন্দুস্থান কি ‘দারুল ইসলাম’, না 'দারুল হারব’! সুতরাং আলিমদের একটি দল ফাতাওয়া দিলেন যে, এখন হিন্দুস্থান না দারুল ইসলাম, না দারুল হার্ব; বরং ‘দারুল আমন' (নিরাপত্তার দেশ); যেমন- মুফতী কেফায়ত উল্লাহ্ সাহেব দেওবন্দী। তিনি হিন্দুস্থানকে ‘দারুল আমন' সাব্যস্ত করলেন। মুফতী আনওয়ার শাহ্ কাশমীরী দেওবন্দীও গবেষণা করে বললেন, (আমাদের দেশ যদি দেশই হয়, তবে এটা 'দারুল আমান ই। [মুহাজির নং-৩৪]
উল্লেখ্য, ফিক্হ্ শাস্ত্রের কিতাবাদির আলোকে বলতে গেলে, এ মাসআলায় অনেক সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে; কিন্তু ‘দারুল আমান' নামের কোন দেশের সন্ধান কোন কিতাবে নেই । ফক্বীহ্গণের এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জনসাধারণ হয়তো 'দারুল ইসলাম'-এর হবে, অথবা 'দারুল হারব'-এর । কিছু সংখ্যক আলিম অবশ্য, হিন্দুস্থানকে 'দারুল হারব' বলেছেন । যেমন। শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী হিন্দুস্থানকে ‘দারুল হারব' বলে ফাতাওয়া দিয়েছেন । [ফাতাওয়া-ই আযীয়্যিাহ্: পৃ. ১৬]
কিছু সংখ্যক আলিম কোন সিদ্ধান্তই দেননি; বরং সারা জীবন সংশয়ে ভুগেছেন।
মৌলভী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব। তিনি তাঁর ফাতাওয়া-ই রশীদিয়া'য় লিখেছেন “হিন্দুস্তান ‘দারুল হারব’ কিনা তাতে আলিমদের মতবিরোধ আছে গবেষণায় একথা প্রকাশ পায় যে, হিন্দুস্থানের অবস্থা ভাল হয়নি।"
[সূত্র, ফাতাওয়া-ই রশীদিয়াহ্, পৃ. ৫০৩)
অথচ মাসআলা (বিষয়)টি একেবারে সুস্পষ্ট। সাধারণভাবে প্রচলিত ফিক্হর কিতাবাদি পাঠ-পর্যালোচনা করলে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হিন্দুস্থান ইংরেজদের শাসনামলেও এবং বর্তমানেও ‘দারুল ইসলাম'। হিন্দুস্থান সম্পর্কে কিছুলোক এ বুনিয়াদ কিংবা দৃষ্টিকোণ থেকে ধোঁকায় পড়েছেন যে, তাঁরা মনে করেন- কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হবার জন্য সেখানে মুসলমানদেরই শাসন ক্ষমতা থাকা জরুরী।
বস্তুত এখানে দু'টি অবস্থা পৃথক পৃথক । 'দারুল ইসলাম' ‘দারুল হারব’ কখন হয়ে যাবে? অর্থাৎ একটি রাষ্ট্র ‘দারুল ইসলাম' ছিলো। তারপর তা কাফিরদের দখলে চলে গেলো। তখন কি কাফিরদের নিছক দখলদারিত্বের কারণে তা ‘দারুল হারব’ হয়ে যাবে, না তজ্জন্য অন্যান্য পূর্বশর্তও থাকতে হবে? কিছু লোক ফিক্বহের কিতাবাদিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং এ মর্মে গবেষণা করলেন যে, যখন মুসলমানদের দখলের ফলে ‘দারুল হারব' 'দারুল ইসলাম’ হয়ে যায়, তখন কাফিরদের দখলদারিত্বের ফলে ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব' হবে কিনা? না মধ্যখানে ঝুলন্ত অবস্থায় 'দারুল আমন' হবে? অথচ এমনটি হয় না; বরং কাফিরদের দখলের সাথে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তও পাওয়া যেতে হবে একটি হলো- ওই রাষ্ট্রে ইসলামী বিধান পালন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সেটার সীমানায় কোন অংশই ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে মিলিত হবে না । সারকথা এ হলো যে, একটি 'দারুল ইসলাম' 'দারুল হারব' হবার জন্য নিম্নলিখিত তিনটি পূর্বশর্ত থাকা জরুরী ১. কাফিরদের পূর্ণ দখলদারিত্ব, ২. ইসলামী বিধান পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া এবং ৩. সেটার সীমানার কোন অংশ ইসলামী রাষ্ট্র (দারুল ইসলাম)-এর সাথে মিলিত হবে না ।
সুতরাং যদি কোন রাষ্ট্রের মধ্যে উক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে কোন একটি শর্তও পাওয়া না যায়, তবে তা হবে 'দারুল ইসলাম। যেমন কান রাষ্ট্রে কাফিরদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিক; কিন্তু তাতে ইসলামী বিধানাবলী একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং কিছুটা এভাবে স্থায়ী থাকে যে, জুমার নামায, দু ঈদের নামায, পাঁচ ওয়াক্বতের নামায ও দাড়ি রাখা ইত্যাদি পালন করা হয়। তাহলে সেটা 'দারুল ইসলাম’ই হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুস্থান ইংরেজদের শাসননামলেও ‘দারুণ ইসলাম' ছিলো। কারণ সুস্পষ্ট, ভারতের উপর ইংরেজদের
শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পালন করতে পেরেছেন। আর এ রাষ্ট্রের সীমানা ইরান ও আফানিস্তানের মতো ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে মিলিত ছিলো । সুতরাং হিন্দুস্থান ‘দারুল ইসলাম’ হবার মধ্যে কোন রূপ সন্দেহই নেই ।
সুতরাং আ’লা হযরত বলেছেন- “আমাদের ইমাম-ই আযম, বরং আইম্মা-ই সালাসাহ্ (ইমামত্রয়) রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিম আজমা'ঈন-এর মাযহাব মতে, হিন্দুস্থান ‘দারুল ইসলাম’; ‘দারুল হারব’ মোটেই নয়। কারণ, ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’ হবার জন্য যেই তিনটি পূর্বশর্ত থাকা প্রয়োজন, তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- ‘সেখানে শিরকী প্রথাসমূহ প্রকাশ্যে জারী হবে । দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সেখানে ইসলামী বিধানাবলী মোটেই পালিত হতে পারবে না। কিন্তু এখানে এ শেষোক্ত বিষয়ের অস্তিত্ব নেই। এখানে মুসলমানদের জুমা, দু’ঈদ, আযান-ইকামত, জামা'আত সহকারে নামায ইত্যাদি শরীয়তের বিধান বিনা বাধায়, প্রকাশ্যে পালন করা যেতো ও যাচ্ছে । তাছাড়া, বিবাহের ফরযগুলো, রাদ্বা‘আত (দুগ্ধপান), তালাক, ইদ্দত পালন, রাজ্‘আত, মোহর, খুলা’, স্ত্রীর ভরণপোষণ, শিশু পালন, বংশীয় ধারা রক্ষা, হিবাহ্, ওয়াকৄফ, ওসীয়ৎ ও শোফ্‘আহ্ মুসলমানগণ ইসলামী আইনানুসারে পালন করেন ও মীমাংসা করেন [সুত্র, প্রাগুক্ত]
প্রসঙ্গত আ’লা হযরতকে কৃত দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেন
বর্তমানকার ‘নাসারা’ (খ্রিস্টান) তাদের আক্বীদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে নিঃসন্দেহে মুশরিক। কারণ, তারা যে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর নুবূয়তকে ‘তাসলীস’ বা (ত্রিত্ববাদ) দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে থাকে, তাতে সন্দেহ নেই । অর্থাৎ তারা তিন খোদায় বিশ্বাসী- ১. আল্লাহ্, ২. হযরত মরিয়ম ও ৩. হযরত ঈসা, এটা নিরেট শির্ক । আর ইহুদীরা হযরত ওযায়র আলায়হিস সালামকে খোদার পুত্র ও খোদা বলে বিশ্বাস করে । এটাও নিঃসন্দেহে শির্ক ।
এ প্রশ্নের উত্তরে আ’লা হযরত ওলামা-ই কেরামের বিভিন্ন অভিমত উল্লেখ করে নিজের অভিমত এটাই প্রকাশ করেছেন যে, সতর্কতা এতেই রয়েছে যে, খ্রিস্টান নারীকে বিবাহ্ করা ও তাদের যবেহকৃত পশু বা পাখী আহার করা থেকে বিরত থাকা। আর বর্তমানে যেসব ইহুদীকে হযরত ওয়াযর আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহর পুত্র হিসেবে (নাঊযুবিল্লাহ্) মান্য করতে দেখা যাবে তাদের নারীকে বিবাহ্ করা এবং তাদের যবেহকৃত প্রাণীর গোশ্ত আহার করা থেকেও বেঁচে থাকা অপরিহার্য । [সূত্র. প্রাগুক্ত]
আলোচ্য বিষয়কে সামনে রেখে এ প্রসঙ্গটার এখানে আলোচনা করলাম । তৃতীয় প্রশ্নের জবাবও যথাস্থানে দেওয়া হয়েছে ।
পরিশেষে, খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো হিন্দুস্তান ‘দারুল ইসলাম' মর্মে ফাতাওয়া প্রদানেও আ'লা হযরত সঠিক ফয়সালাটিই মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছিলেন ।
🔁গতপর্বের লিঙ্ক:-https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=336236964891432&id=100055153927069